পেন্সিলে লিখা বাবার ডায়েরি (ধারাবাহিক উপন্যাসঃ পর্ব-১২)
লিখেছেন লিখেছেন মামুন ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০১:৫১:৫৪ দুপুর
আমার বাবু!
দূরে থাকতে থাকতে বাবার সাথে আমার দূরত্বটা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে গেল। বাবা হয়ত ব্যাপারটা খেয়াল ও করলেন না। ব্যস্ততা বাড়ছিল বাবার। ভাববার অবসর তার ছিল বলে মনে হয় না। ঘরে বাবার অফিসের লোকজনের জন্য মাঝে মাঝে খানাপিনার আয়োজন হতে শুরু করল। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে তারা দেশের অর্থনীতি, ভোট, রাজনীতি, অফিস নানান ব্যাপারে কথা বলতেন। সেসব আলোচনায় আমাদের পরীক্ষা আর রেজাল্ট ছাড়া অন্য প্রসংগ কমই আসত।আমাদের সাথে তাদের লেনদেন ছিল সালাম, সম্ভাষন, কুশল জিজ্ঞাসা পর্যন্ত। তারা এলে কথার ফোয়ারা বইত বসার ঘরে। বাবাকেও অনেক কথাই বলতে শুনতাম। তখন তাদের সব কথা বুঝি ও না। পাশের রুম থেকে শোনা সেসব কথার কিছু কিছু শব্দ, ধারণা নিয়ে ভাবতাম। ঘুরেফিরে তারা একটা কথায় ফিরে আসতেন। বিষয়টা ছিল, 'দেশে মার্শাল ল' কতদিন থাকতে পারে '। আমি ভেবে পেতাম না, ভোট 'ব্যাপারটা নিয়ে এত ভাববার কি আছে!
গ্রামের বাড়ি থেকে আমার দাদীকে নিয়ে এলেন মেঝ দাদা। চাঁপা ততদিনে এটা ওটা ধরে হাঁটতে শিখেছে। এতো দিন পরে নতুন নাতনিকে দেখতে এলেন। মেঝ চাচা দিয়ে গেলেন। কিছুতেই বারান্দায় পর্যন্ত উঠলেন না। সিড়ির উপর দাদীর ব্যাগ দুটো রেখে দিলেন। মা আমাদের দুই ভাইকে ডাকলেন। সালাম করে মেঝ চাচার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তিনি আমাদের ঘরটা দেখছেন অন্যমনষ্ক হয়ে। সে সময় কি তিনি ভাবছিলেন, প্রায় খালি হাতে শহরে এসে এত অল্প সময়ের মধ্যে একটা বাড়ির মালিক কিভাবে হয়েছেন বাবা? আমি ভাবছিলাম, মেঝ চাচার বাড়িটার চেয়ে আমাদের বাসা অনেক বড়। অনেক সুন্দর। হয়ত তিনিও তাই ভাবছিলেন।
বাদল মেঝ চাচাকে সালাম দিয়েই খুব খুশি হয়ে চাঁপার কথা বলল। মেঝ চাচা কোন আগ্রহ দেখালেন না। বললেন তিনি তখনই বাড়ি রওনা হবেন। বাদল চাচার সামনে থেকে সরে মায়ের পাশে একটু আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। ওখানে লুকিয়েই ও মেঝ চাচাকে আড়াল থেকে দেখছিল। ও বোধহয় চাচার এই ব্যবহার আশা করেনি। মা মেঝ চাচাকে রাতটা থেকে যাওয়ার অনুরোধ করলেন। চাচার থমথমে চেহারায় দেয়া না বোধক উত্তরের পর মা আর কিছু বললেন না। চাঁপা সেদিন সন্ধ্যার আগেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। সে মেঝ চাচাকে দেখল না। মেঝ চাচা চলে গেলেন। মেঝ চাচা যতক্ষণ ছিলেন বাবা ততক্ষণ ঘরের বাইরে এলেন না।
প্রতিশোধ!
মেঝ চাচা যাওয়ার পর বাবা অসময়ে বাজারে গিয়ে দাদীর পছন্দের এটা ওটা কিনে আনেন। রান্না শেষ হতে রাত হয়ে যায়। আমরা দুই ভাই দাদীর দুই পাশে বসে চাঁপার সারাদিনের কাজের বর্ণনা দিচ্ছি মহা উৎসাহে। দাদী হঠাৎ মন খারাপ করে ফেললেন। মা খেয়াল করলেন। বললেন, ' এসেই বাড়ির জন্য খারাপ লাগছে? '
দাদী মলিন মুখে বললেন, ' মেঝ ঘরের দরজা থেকে চলে গেল! বাচ্চাটার মুখটা দেখে যেতে পারত! ভিতরেও আসল না। জেদ। সম্পর্ক থেকে জেদ বড়! ভাইয়ে ভাইয়ে এতোটা পর্যায় পর্যন্ত আলগা হয় কেউ? আল্লাহ আমার ছেলেগুলোকে একটু বুঝ বুদ্ধি দিত! '
মা একটু মনমরা হাসলেন। বাবা কিছু বললেন না।
খেতে বসে দাদী বাবার দিকে ভালো করে তাকাচ্ছিলেন না। মা দাদীর পাতে মাছ, মাংস তুলে দিচ্ছিলেন। দাদী হয়ত রাগ করেছিলেন। বাবা নিজে ছোট বলে হোক, বাবার ঘরের দরজায় চাচা মেহমান এসেছিলেন বলে হোক, বাবা তো আসলেই একবার কথা বলতে পারতেন!
খাওয়ার শেষের দিকে দাদী গম্ভীর মুখে একবার বাবাকে শুধু বললেন, ' অনেক সুন্দর করে ঘর করেছ বাবা। ' বাবা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন। মা দাদীকে শোবার জায়গা দেখিয়ে দিতে নিয়ে গেলেন।
পরদিন ছুটির দিন ছিল। মা খালা, খালুকে দুপুরে খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। খালা এলেন আগে। একা। গাড়ি নিয়ে। সব সময়ের মত শড়ি গয়নায় ঝলমল। হাসিখুশি। কিন্তু আমিতো জানতাম তিনি কেমন আছেন।
বিকালে খালু এলেন। গাড়ি ভর্তি মিষ্টি নিয়ে। কিন্তু দাদীকে সালাম করলেন না। না দেখার মত করে হাত বাড়িয়ে বাবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে গেলেন। দাদী মন খারাপ করলেন কিনা তা বুঝতে দিলেন না। আমার খারাপ লাগল। বাবা খালুকে নিয়ে বসার ঘরে বসে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা করলেন। খালুর অহমিকা তার কথার সুর আর মুখের ভংগিতেই ভাসত। মা বলতেন তাঁরা হঠাৎ করে প্রচুর টাকার মালিক হয়ে যাওয়াতে সামান্য কম পয়সার মানুষকে আর দেখেই না। আর দাদী তো এক প্যাচ সুতার শাড়ি পরেছিলেন। খালু হয়ত অন্য কিছু ভেবেছেন। বাবাও কেন পরিচয় করিয়ে দিলেন না কে জানে!
আমার এই খালু কিভাবে তার চাকুরিতে বসে দেশেকে ধ্বংস করে ঘুসের টাকা আয় করছে, অসৎ অফিসার এবং তার চারপাশের কুৎসিত জগতটা সম্পর্কে বাবা মা'কে কখনো কখনো কথা প্রসংগে বলতেন। আমাদের কানে তার কিছু কথা আসত, কিন্তু তা নিয়ে মন্তব্য বা প্রশ্ন করার শিক্ষা বা অধিকার আমাদেরকে দেয়া হয়নি। দুই এক কথায় রাগের আভাস থাকত। কখনো নেহায়েতই হাসি ঠাট্টা।
ছোট খালুকে আমার কখনোই ভালো লাগত না। আমাকে প্রথম দেখায় তিনি টিটকিরি দিয়ে কিছু বলেছিলেন। কথাটা ভুলে গেছি, কিন্তু লোকটার মুখের গা জ্বালানো হাসিটা কিছুতে ভুলতে পারি না। বাবা বলতেন খালুর চেহারা নাকি রাজকীয়। আমি কোন সৌন্দর্য্য খুঁজে পেতাম না। মানুষের ভিতরটা ভালো না হলে বাইরেটাতে মন ভোলে না। ছোট খালার কথা ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যেত। বেচারি সাদাসিধা মানুষটা!
একদিন ছোট খালাদের দারোয়ানটা কী দোষ করেছিল। খালু ওই বুড়ো লোকটাকে রাস্তার উপর দাঁড়িয়ে এত জোরে চড় মারলেন। লোকটা মাথা ঘুরে রাস্তায় পড়ে গেল। রাস্তায় লোকজন ফিরে দেখে কি বুঝল কে জানে, মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। কেউ দাঁড়াল না। কিছু জানতে পর্যন্ত চাইল না। সম্ভবত তারা ছোট খালাদের প্রতিবেশী। চেনা জানা। আমরা তখন উনার পিছনে, উনারই মাইক্রো'তে। একসাথে পিকনিকে যাচ্ছিলাম। আমার খুব রাগ হল। দেখলাম বাবা মা না দেখার ভান করলেন। ছোট খালা মাথা নিচু করলেন। আমি বুড়ো লোকটার কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ানো দেখলাম। ভাবছিলাম লোকটা কি রাগে কাঁপছে? শীতে কাঁপছে? বুড়ো হলেও সে খুব দুর্বল শরীরের ছিল না। ভারী গোঁফ ও ছিল। দেখতে ভয়ই লাগত। কিন্তু তার মুখে চোখে ভয় দেখলাম। সে চোখ তুলে খালুর দিকে তাকাল না। পরে ভেবে দেখেছি, ভয়টা খালুকে না। বাবা যে কারণে এমন করে নিজেকে বদলে আরেকজন হয়ে গেছেন, সেই কারণেই দারোয়ান লোকটা খালুকে কিছু বলতে পারল না। চাকরি। নইলে সে গর্জাতে ও পারত বেশ, মারতেও ওস্তাদ ছিল। অন্যদিন ওই লোকটাকে এক ভিখারীকে ধরে ধমকাতে আর মারতে দেখেছি। লোকটা এমন একটা লোকের জন্য তার চেয়ে দুর্বল একটা মানুষকে মারে, যে লোকটা তাকে ছোট ছোট কারণে যখন তখন এভাবে অপমান অপদস্থ করে!
এখন জানি সে খালুর মধ্যে যে ক্ষমতা দেখত তার প্রতিবাদ না করতে পারার কারণটা। সে নিজেকে কারো কারো সামনে এমনই ক্ষমতাবান হিসাবে দেখত। কাজেই ক্ষমতার বিরোধিতা সে করতে পারত না। সে বরং খালুকে ক্ষমতার চুড়ায় বসিয়ে নিজেকে সেই ক্ষমতার একটা অংশ হিসাবে দেখত। খালুকে সে তার আনুগত্য দিয়ে ক্ষমতাবান করত!আমার ওই খালু, যিনি অনেক ব্যবসায় দেদার টাকা খাটাতেন, নিজের অন্যের যে কোন রকম টাকাকে কিভাবে ভোগ করতে হয় তার টেকনিক জানতেন, কর্মচারীদের বেতন ঠিক সময়ে দিতেন না, পাওনাদারকে ধমক দিয়ে তাড়াতেন আর এভাবে এদের সবার নাগালের বাইরে সরানো টাকা দিয়ে নিজে বিলাসিতা করতেন আর তার চেয়ে ক্ষমতাবানদেরকে খুশি রাখতেন, তিনিও তার উপরে কিছু ক্ষমতাবান তৈরী করেছিলেন, ছাদ হিসাবে ব্যবহারের জন্য। এই বানানো ছাদের একটা অংশ ছিলেন আমার বাবা!
সমাজতন্ত্র বিশ্বাসীরা যৌথ খামার, সম্পদ আর শ্রমের সম বন্টন আর শ্রেণীহীন সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন, অনেক কিছুই ভেবেছেন,বলেছেন, করেছেন। সম্পর্কের জটিল জাল এই সমাজের প্রতিটি গিটে যে মানসিকতা তা দূর করা কি সহজ? সম্ভব? খালুর এই দারোয়ানকে যদি কেউ' সমান অধিকার আর কর্তব্য 'বোঝাতো , সে কি মাস শেষে নিশ্চিত বেতনের লোভ ছাড়তে পারত? যদিও তা তারিখের হেরফের করে আসে, তবু, সে কি রাজী হত?
খালুর গ্রামের বাড়ি ছিল ডুমুরিয়া। এটা ছিল খুলনার একটা উপজেলা। এখানে চরমপন্থি দলের অনেক বড় ঘাটি ছিল। খালু সেখানের অনেক জমি সস্তায় কিনে রেখেছিলেন। খালুর এই হঠাৎ করে এতো জমিজমার মালিক হওয়া সেখানের পুর্ববাঙ্গলা কম্যুনিষ্ট পার্টির লোকেদের চোখে পড়েছিল। তাঁকে বিভিন্নভাবে থ্রেট দেয়া হয়েছিল। তাই পারতপক্ষে তিনি বাড়িতে যেতেন না। শহরের পুলিশ প্রশাশনের সাথে তার খুব দহরম মহরম ছিল। তিনি বরং শহরেই নিরাপদ বোধ করতেন। প্রশাসনকে লালন পালনের বাঁকা পথ তিনি জানতেন। বিপ্লবী পালতে কেন শেখেন নি তখনো। এত কুবুদ্ধি ছিল তার। 'অত্যাচারী চিরকালই ভীরু' বলেই হয়ত সোজা সাপ্টা লেনদেনে লোকটা যেতেই পারত না। কিছু কিছু জায়গায় লোকটার থাবা থেকে নখ বের হত না। সে শহরের অফিস আদালত আর থানায়ই স্বস্তিতে শিকড় গেড়েছিল। তার প্রভাবের বিস্তার ছিল এমনকি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত ও।
(ক্রমশঃ)
বিষয়: সাহিত্য
১০১৮ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
http://www.bdmonitor.net/blog/blogdetail/detail/9344/Al Mamun Khan/58405
কেমনে কি ? কে আপনার মান ভাঙ্গালো?
আসলে আপনি না, আমি-ই হতভাগা। নাহলে কি আর আপনার কাছ থেকে একটু ভালোবাসা পাওয়ার আশা করতে পারি না!
আমি এবেলা ওবেলা ভাইয়ের কমেন্ট দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আমার লিখা কন্টিনিউ করার সিদ্ধান্ত নেই।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।
বাই দ্য ওয়ে, আমি কন্টিনিউ করাতে আপনি কি খুশী হন নি?
আপনার লেখা না পড়লে মনে হয় পেটে খাবার হজম হয়না। আমি সংসারের নানা ব্যস্ততায় নিয়মিত লিখতে পারিনা তবে আপনার লেখা নিয়মিত চাই এবং পড়তেও চেষ্টা করি।
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
ইনশা আল্লাহ যতটুকু পারি, লিখে যাচ্ছি।
সাথে থাকার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
জাজাকাল্লাহু খাইর।
বইমেলায় আপনার কি কোনো বই আসছে?
না, আর পরিণত হয়ে নেই। আগামী ২০১৬ বই মেলায় ইনশা আল্লাহ বের করার ইচ্ছে রয়ে গেছে।
শুভ কামনা রইলো আপনার জন্য।
ক্ষমতার এই স্তর বাই স্তরের দাপটেই সাধারণ জনতা জেগে উঠতে কিছু টা হীনমন্যতায় ভোগে!
প্রকৃত জেগে উঠায় যদিও সব স্রোতের দাপটে ভেসে যায় কিন্তু এই উপলব্ধিটা স হজে আসে না!
অনেক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহু খাইরান!!
আপনাকেও ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা নিরন্তর..
মন্তব্য করতে লগইন করুন